• শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৪ ১৪৩১

  • || ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

হিংসা: আসমান ও জমিনের প্রথম পাপ...

দৈনিক ঠাকুরগাঁও

প্রকাশিত: ১১ নভেম্বর ২০১৮  

হিংসা মানুষের একটি প্রাকৃতিক খারাপ গুণ। প্রতিটি মানুষের ভেতরেই কিছু না কিছু হিংসা তাড়িয়ে বেড়ায়।

তবে যারা এ হিংসা দমন করতে পারে তারাই মহান, মহামানুষ। মহৎ মানুষের মন হবে উদার। যারা অন্যের কল্যাণ সাধানায় সবর্দা নিজেকে নিয়োজিত রাখবে। ভালো কাজ থেকে হিংসা না করে অনুপ্রেরণা নিবে। হিংসা করা এতোই নিকৃষ্ট যে, এর কারণে সকল মানুষই কষ্ট পায়। যার প্রতি হিংসা করা হয় সে তো কষ্ট পায়, এমনকি খোদ হিংসুক নিজেও এর কারণে কষ্ট পায়। এছাড়াও হিংসার আগুন যখন জ্বলে ওঠে তখন আশপাশের লোকও এ থেকে রেহাই পায় না। মানুষকে হিংসা থেকে রক্ষা পেতে মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই পবিত্র কোরআনে দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন,

وَمِن شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ

‘আর (আশ্রয় চাচ্ছি) হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।’ (সূরা ফালাক : ৫)

পবিত্র আল কোরআনের অনেক স্থানে হিংসার নিন্দা করা হয়েছে। বিশেষ করে হিংসুক জাতি ইহুদিদের আচরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, তাদের অবাধ্যতার জন্য হিংসা নামের বদচরিত্রই দায়ী। যেমন, এক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নাকি তারা মানুষের প্রতি এজন্য হিংসা করে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের স্বীয় করুণা দান করেছেন।’ (সূরা: নিসা, আয়াত : ৫৪)

হিংসা থেকে বারণ করে মহান আল্লাহ তায়ালা অপর স্থানে বলেন, ‘আর তোমরা কামনা করো না ওই জিনিস, যা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের কাউকে অপর কারো ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন।’ ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘হাসাদ বা হিংসা করা নিন্দনীয় এবং হিংসুক নিজে সর্বদা চিন্তাযুক্ত থাকে। হিংসা নেক আমলকে সেভাবে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন কাঠকে খেয়ে ফেলে।

বলা হয়, ‘হাসাদ বা হিংসা হলো পৃথিবীর প্রথম পাপ, যা আসমানে করা হয়েছিল আর তা দুনিয়ারও প্রথম পাপ। আসমানে আদম (আ.) এর প্রতি হিংসা করেছিল ইবলিশ। আর জমিনে কাবিল হিংসা করেছিল তার ভাই হাবিলের প্রতি।’

অসংখ্য হাদিসেও এ ব্যাপারে উম্মতকে সতর্ক করা হয়েছে। যেমন, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা পরস্পরের প্রতি হিংসা করো না, একে অন্যের পেছনে পড় না। আর তোমরা পরস্পর ভাই হিসেবে আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও।’

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত অপর এক হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা হিংসা করা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা হিংসা নেক আমলকে সেভাবে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন কাঠকে খেয়ে ফেলে।’

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে যেমন হিংসা নিন্দনীয়; সামাজিক দৃষ্টিতেও হিংসুক নিন্দনীয় একজন মানুষ। মানুষের চোখে হিংসুকের কোনো স্থান নেই। হিংসা পরিত্যাজ্য মানুষ দুনিয়া ও আখেরাত দুই জীবনেই প্রিয় মানুষ বলে বিবেচিত হবে।

হিংসায় কর্ম নষ্ট হয়:

মানুষ স্বভাবজাত হিংসাপ্রবন। অন্যের ভালো সাধারণত মানুষ সইতে পারে না। এটি মানুষের নিকৃষ্টতম একটি গুণ। মানুষ মানুষকে হিংসা করে, দল দলকে, সমাজ সমাজকে, দেশ দেশকে, রাজনীতিবিদ অপর রাজনীতিবিদকে হিংসা করে। হিংসা করে অপরের ভালো কাজ, অন্য দেশের উন্নয়ন, সমাজে এগিয়ে যাওয়াকে দমিয়ে দিতে চায়। ফলে সৃষ্টি হয় দাঙ্গা হাঙ্গামা যুদ্ধ।

পরিবার থেকে নিয়ে দেশ, সমাজ রাষ্ট্রে এর উদাহরণ কম নয়। হিংসার কারণে সমাজ ও রাষ্ট্রের অধপতন ঘটেছে এমন উদাহরণও কম নয়। তাই ইসলামে এ হিংসাকে মানুষের মারাত্মক ব্যাধি ও হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। হিংসার ফলে নিজের ভালো কাজও ধ্বংস হয়ে যায়।

ইসলাম অন্যের প্রতি হিংসা করা বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হওয়াকে সম্পূর্ণরুপে হারাম বা নিষিদ্ধ করেছে। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষের স্থলে সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করে বলেছেন, ‘আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন, সে জন্য কি তারা তাদের ঈর্ষা করে?’ (সূরা: আন নিসা, আয়াত: ৫৪)

হিংসা-বিদ্বেষ একটি ভয়ানক সংক্রামক ব্যাধি। মানুষের হীন মনমানসিকতা, ঈর্ষাপরায়ণতা, সম্পদের মোহ, পদমর্যাদার লোভ-লালসা থেকে হিংসা-বিদ্বেষের উৎপত্তি ও বিকাশ হয়। হিংসা-বিদ্বেষ মুমিনের সৎ কর্ম ও পুণ্যকে তার একান্ত অজান্তে কুরে কুরে খেয়ে ফেলে। মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, শঠতা-কপটতা, অশান্তি, হানাহানি প্রভৃতি সামাজিক অনাচারের পথ পরিহার করে পারস্পরিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে এবং ইসলামের পরিশীলিত জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ হবে এটিই ধর্মের মূলকথা। তাই নবী করিম (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নিবৃত্ত থাকবে। কেননা, হিংসা মানুষের নেক আমল বা পুণ্যগুলো এমনভাবে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়।’ (আবু দাউদ)

ঈর্ষা বা হিংসা মানুষকে কত অধঃপতনে নিয়ে যায়, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ঈর্ষা ও হিংসা প্রায় একই রকম আবেগ, তবে হিংসাকে বলা হয় ঈর্ষার চরম বহিঃপ্রকাশ। ঈর্ষাকাতরতা হিংসার পর্যায়ে চলে গেলে আক্রোশবশত মানুষ হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলতে পারে। হিংসুক ব্যক্তি অন্যের ভালো কিছু সহ্য করতে পারে না, কাউকে কোনো উন্নতি বা ক্ষমতায় অভিষিক্ত দেখলে অন্তরে জ্বালা অনুভব করে। এহেন অশোভন আচরণ ইসলামের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। হিংসুক ব্যক্তি যখন হিংসাত্মক কাজে লিপ্ত থাকে, তখন তাকে পরিত্যাগ করা অবশ্যকর্তব্য।

এ জন্য হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকার লক্ষ্যে মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার জন্য পবিত্র কোরআনে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, ‘আর হিংসুকের অনিষ্ট থেকে পানাহ চাই, যখন সে হিংসা করে।’ (সূরা: আল ফালাক, আয়াত: ৫)

দৈনন্দিন জীবনে হিংসার বহুবিধ কারণ যেমন- পারস্পরিক ঈর্ষাপরায়ণতা, পরশ্রীকাতরতা, শত্রুতা, দাম্ভিকতা, নিজের অসৎ উদ্দেশ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা, নেতৃত্ব বা ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা, অনুগত লোকদের যোগ্যতাবান হয়ে যাওয়া এবং কোনো সুযোগ-সুবিধা হাসিল হওয়া, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নীচুতা বা কার্পণ্য প্রভূতি বিদ্যমান। নানা কারণে এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির প্রতি হিংসা প্রকাশ করে থাকে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করা থেকে বেঁচে থাকবে, কেননা এরুপ ধারণা জঘন্যতম মিথ্যা। আর কারও দোষ অনুসন্ধান করবে না, কারও গোপনীয় বিষয় অন্বেষণ করবে না, একে অন্যকে ধোঁকা দেবে না, পরস্পর হিংসা করবে না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করবে না, পরস্পর বিরুদ্ধাচরণ করবে না, বরং তোমরা সবাই এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে থাকবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

কোনো কারণে কারও প্রতি শত্রুভাবাপন্নতা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ধরে রাখার নাম বিদ্বেষ। একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করার বিষয়টি বদভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামে পারস্পরিক বিদ্বেষ পোষণ করা হারাম। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘তিন ব্যক্তির গুনাহ মাফ হয় না, তার মধ্যে একজন হচ্ছে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তি।’

হিংসা-বিদ্বেষের কঠিন পরিণতি সম্বন্ধে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার মানুষের আমলগুলো পেশ করা হয় এবং সব মুমিন বান্দার গুনাহখাতা মাফ করে দেওয়া হয়; কিন্তু যাদের পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ ও দুশমনি আছে, তাদের ক্ষমা করা হয় না। তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন তাদের ছেড়ে দাও, যেন তারা ফিরে আসে অর্থাৎ মিলে যায়।’ (মুসলিম)

ধর্মপ্রাণ মানুষের চরিত্র গঠনে হিংসা-বিদ্বেষ বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এতে মানুষে-মানুষে ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি, হানাহানি ও দ্বন্দ-সংঘাতের উদ্ভব ঘটে। ইমানদারদের মন থেকে সব ধরনের হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে সমাজের সবার সঙ্গে শান্তিতে মিলেমিশে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা বাঞ্ছনীয়।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলোর মুণ্ডনকারী (ধ্বংসকারী) রোগ ঘৃণা ও হিংসা তোমাদের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে আসছে। আমি চুল মুণ্ডনের কথা বলছি না, বরং তা হলো দ্বীনের মুণ্ডনকারী।’ (তিরমিজি ও আহমাদ)

পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ পরিত্যাগ করে বিশ্বের সব সৃষ্টির সেবা ও জনকল্যাণ কামনাই হলো সত্যিকারভাবে ইসলামের অনুশীলন। কিন্তু হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী লোকেরা শরিয়তের পরিপন্থী কাজ করে দ্বীন ইসলামের মূলে কুঠারাঘাত করে। বাহুবলে হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষাকাতরতা ও শত্রুতা বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক জীবনে শান্তি ফিরে আসে না।

তাই কোনো কিছু নিয়ে হিংসা-বিদ্বেষ করা উচিত নয়। নিজের যা কিছু আছে, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। অন্যের দিকে তাকিয়ে বিদ্বেষ পোষণ করে হিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ নেই। সুতরাং আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে হলে ধর্মপ্রাণ মানুষকে অবশ্যই সর্বাবস্থায় হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে সুন্দর মনমানসিকতায় সৎভাবে পরিশীলিত জীবনযাপন করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।

হিংসা থেকে বাঁচার উপায়:

হিংসা থেকে বাঁচার জন্য আমাদের উত্তম আচরণ ও পবিত্র অন্তরের অধিকারী হতে হবে। অন্য লোকরা উপভোগ করছে, এমন নিয়ামত নিজের জন্য প্রত্যাশা করার অনুমতি রয়েছে এই শর্তে যে, উপভোগকারী কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে তা কেড়ে নেয়া হোক এটা প্রত্যাশা করা যাবে না এবং অন্য কেউ এই নিয়ামত ভোগ করুক, তা-ও অপছন্দ করা যাবে না।

মানুষের উচিত, অপরকে কী দেয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে চিন্তা না করে তাকে যেসব নেয়ামত দেয়া হয়েছে, সেগুলোর কথা চিন্তা করা এবং প্রয়োজনে তা গণনা করা। মানুষ যখন মহান আল্লাহপ্রদত্ত নেয়ামতের কথা অধিক মাত্রায় স্মরণ করে, তখন রাব্বুল আলামিন আল্লাহর প্রতি তার শোকরগুজারির মাত্রা বৃদ্ধি পায়।

তাই সবার উচিত হিংসা থেকে মহান রাব্বুর আরামিন আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া যেন মহান আল্লাহ আমাদের অন্তর থেকে যাবতীয় হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে দেন। আল্লাহুম্মা আমিন।

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –