• শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৪ ১৪৩১

  • || ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিশু মনে তাওহিদের বীজ বোনো

নিজস্ব প্রতিবেদক

দৈনিক ঠাকুরগাঁও

প্রকাশিত: ২২ নভেম্বর ২০১৮  

তাওহীদের প্রতি বিশ্বাস মানবজীবনের প্রধান বিষয়। তাওহিদের প্রতি বিশ্বাস ছাড়া পরকালে মুক্তি নেই। তাই শৈশবকাল থেকেই শিশুকে তাওহিদের প্রতি বিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে হবে।

ছেলেবেলাতেই শিশুকে তাওহিদের মর্ম উপলব্ধি করানো অভিভাবকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। শিশুর বয়ঃপ্রাপ্তি বা বড় হওয়ার সময়ের জন্য এ বিষয়গুলো রেখে দেবে না। কথা ও কাজে তার সামনে এক কথারই পুনরাবৃত্তি করতে হবে: ‘আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন, আহার্যের জোগান দিয়েছেন, তার কোনো অংশীদার নেই। নিশ্চয়ই তিনি মহিমান্বিত, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, সৃষ্টিকুল সকলেই তার মুখাপেক্ষী।

আল্লাহ তায়ালা প্রজ্ঞাময় ন্যায়পরায়ণ, তিনি মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র অবিচার করেন না। ইত্যাদি বিষয়গুলো শিশুর অন্তরে গেঁথে দিতে হবে। আল্লাহ তায়লার নান্দনিক ও বিমূর্ত গুণাবলি যেমন : মহত্ব, বড়ত্ব, ক্ষমতা, শক্তি, শ্রবণ ও দৃষ্টি ইত্যাদিকে আমরা তার জন্য স্বীকার করি। এক্ষেত্রে তার সামনে কালামুল্লাহর পুনরাবৃত্তির চেয়ে অতিরিক্ত অন্য কিছুর দরকার নেই। যেখানে সন্নিবেশিত রয়েছে তার নান্দনিক গুণাবলি ও তাওহিদের ব্যাপক অর্থ। এ বিষয়ে কোনো বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না, যেহেতু এগুলো হলো এমন বিষয় যার ওপর সাধারণ মানুষের স্বভাবজাত সত্তা গড়ে উঠেছে। সুতরাং এটা শুধু স্মরণ করিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট। এর বেশি প্রয়োজন নেই।

হাদিস শরিফে এসেছে, শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার কানে সর্বপ্রথম তাওহিদের শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি করবে; যদিও সে তখন এর অর্থ বুঝতে সক্ষম না। উবায়দুল্লাহ বিন আবু রাফে’ তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘ফাতেমা (রা.) যখন হজরত হাসান (রা.)-কে প্রসব করলেন; তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তার কানে নামাজের আযান দিতে আমি নিজে দেখেছি।’ আজানের সকল শব্দই তাওহিদ ও কল্যাণের উদাত্ত আহ্ববান।

বর্ণিত আছে, ‘উমার বিন আব্দুল আজিজ (রহ.) এর একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাকে একটি কাপড়ের টুকরায় ধরে ডান কানে আজান ও বাম কানে ইক্বামত দিলেন এবং সেই স্থানেই তার নাম রাখলেন।’ এটা একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে একত্ববাদের বাণী ও কল্যাণের আহ্ববান শোনানোর প্রশিক্ষণ। যদিও সে তার মর্ম বুঝে না। এটা তার-ই মতো যে তার অবুঝ শিশুকে বিদেশি ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করে এ উদ্দেশ্যে যে, যদিও তার পড়াশুনার বয়স হয়নি তবুও সে ঐ স্কুলে আসা-যাওয়ার মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হবে।

বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে আদর্শের শিক্ষা দিন:

উপদেশ, বক্তৃতা ও আলোচনার চেয়ে বাস্তব পদক্ষেপ শিক্ষার্থীর ওপর অপেক্ষাকৃত বেশি প্রভাব বিস্তার করে। কারণ সংঘটন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার সত্যায়নের প্রমাণ মেলে। অতএব, অভিভাবককে প্রশিক্ষণের অবকাঠামো শক্তভাবে ধারণ করা- যার দিকে তিনি শিক্ষার্থীকে আহ্ববান করবেন- বাস্তবে অনুশীলন ব্যতিরেকে প্রশিক্ষণের গুরুত্ববিষয়ক আলোচনা ও তার দিকে আহ্ববানের চেয়ে বেশি কার্যকর। সুতরাং শিশুর সম্মুখে অভিভাবকের সকল কর্মকাণ্ডে কঠিনভাবে সততা অবলম্বন না করতে পারলেও শুধু সততার গুরুত্ব ও মূল্যায়নবিষয়ক আলোচনার চেয়ে শিশুর জন্য ফলপ্রসূ হতে পারে।

ইমাম শাফেয়ী (রহ.) ‘আদর্শ’ শিক্ষা দেওয়ার গুরুত্বের ওপর সতর্ক করেছেন, যখন তিনি বাদশা হারুনুর রশিদের সন্তানদের শিষ্টাচার শিক্ষাদানরত অবস্থায় আব্দুস সামাদের পিতার নিকট আগমন করলেন। তিনি বললেন, ‘আমিরুল মু’মিনীনের সন্তানদের সংশোধনের সূচনা করার পূর্বে নিজের সংশোধন করে নেয়া উচিত।’ যেহেতু তাদের চক্ষু তোমার চক্ষুর সঙ্গে আবুদ্ধ। অতএব, তাদের নিকট তা-ই সুন্দর যা তুমি সুন্দর মনে করে থাকবে আর মন্দ যা তুমি মন্দ মনে করে থাকবে।

একজন অভিভাবক যখন সর্বাবস্থায় কাজের মাধ্যমে তার সকল কথার সত্যায়ন করতে পারবেন তখন শিক্ষার্থীর জন্য এটা বেশ ফলপ্রসূ হতে বাধ্য। যদিও এটা কোনো পার্থিব বিষয় সংক্রান্তই হোক না কেন। যেমন: আমাদের বর্তমানকালের লাল রঙের রোড সিগনালের নিকট এসে যদি অভিভাবক নিজে থেমে যায়। তাহলে শিশু সে আদর্শ অনুসরণ করবে। আর যদি অভিভাবক সেটা না করে রেড সিগনাল উপেক্ষা করেন তাহলে শিশু তা-ই করবে। এবং তাকে এটা না করতে সতর্ক করা হলেও সে বলবে আমি আব্বুকে দেখেছি তিনি এটা উপেক্ষা করতেন। অতএব, বাস্তব কর্ম শিশুদের শিক্ষার জন্য অধিকতর কার্যকরী উপদেশ প্রশিক্ষণের চেয়েও। একটি শিশু তার অভিভাবককে যখন নিঃস্বদের প্রতি অনুগ্রহ ও দুর্বলদের প্রতি সাহায্য করতে দেখতে পাবে, তখন নিঃসন্দেহে এটা শিশুকে তার আনুগত্য ও অনুসরণ করতে উদ্বুদ্ধ করবে। নিজের মধ্যে প্রতিফলন না ঘটিয়ে শুধু দানের তাৎপর্য ও গুরুত্বের ওপর আলোচনা করার চেয়ে এটা হবে অনেক বেশি ফলপ্রসূ।

উপরন্তু এক্ষেত্রে শিশুকে যথাযথভাবে অনুপ্রাণিত করা অভিভাবকের একান্ত কর্তব্য। যেমন: সে অভাবীকে যে টাকাটা দিতে চায় তা পকেট থেকে বের করে নেবে, এরপর শিশুটিকে বলবে এটা নিয়ে অভাবীকে দিয়ে আস। তিনি এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিপালনের লক্ষ্য বেশ বাস্তবায়ন করতে পারবেন। সুতরাং ঐ লোকটিকে দান করার কারণ সে-ই শিশুটিকে বলে দেবে। আর তা হলো নিঃস্ব ও অসহায়কে সাহায্য করা। সে অভাবী নয়, এমন লোকদের জন্য নিজের সম্পদ ব্যয় করতে ও দানশীলতায় নিজেকে অভ্যস্ত করতে সক্ষম হবে। ইবনুল ক্বায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘তাকে দান ও ব্যয় করতে অভ্যস্ত করাবে, অভিভাবক যদি কিছু দান করার পরিকল্পনা করেন। তাহলে নিজে না করে শিশুর হাত দিয়ে দান করাবেন, যাতে সে দানের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে।’

এমনিভাবে এই আচরণ তাকে সাহসিকতা ও অপরের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহারের শিক্ষা দেবে। আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) এর কর্মপদ্ধতিও ছিল এরকম। ‘ইবনে উমার (রা.) এর নিকট জনৈক ভিক্ষুক এলে তিনি তার ছেলেকে বললেন, তাকে একটি দিনার দিয়ে দাও!’ কখনও বা এমন ঘটনাও সংঘটিত হতে দেখা যায় যে, শিশু নিজেই তার বাবার কর্ম প্রত্যক্ষ করার পর বাবার নিকট চলে এসে অভাবীকে দান করার জন্য কিছু চায়। অভিভাবকের এ অবস্থায় তাকে বারণ করা উচিত হবে না। এমন কি অভিভাবক ভিক্ষুককে ঐ দানের উপযুক্ত মনে না করলেও। যেহেতু আমরা এখন শিশুটির জন্য এই চরিত্রটা বিনির্মাণের স্তরেই রয়েছি। এই ভিক্ষুক দান পাবার যোগ্য কি যোগ্য নয়, এই বিবেচনা এখানে সঙ্গত নয়।

অতএব, শিশুর যত্ন ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘এমন অবকাঠামোর দ্বারা তার আচার-আচরণ গড়তে হবে যার সঙ্গে শিশুর চরিত্রবান হওয়া আমাদের কাম্য। কারণ এটা শুধু গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, কার্যত বাস্তব আচরণ।’ গল্পে গল্পে শিক্ষা:

অভিভাবক ও শিক্ষক একটি সত্য ও বাস্তবানুগ গল্প নির্বাচন করতে পারেন। অধিকাংশ সত্য ও বাস্তব গল্পের মাধ্যমে আমাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারি। গল্পের বিভিন্ন শিক্ষণীয় দিক সম্বলিত অংশবিশেষ থেকে আমাদের সন্তানদের প্রতিপালন ও পরিচর্যা করতে পারি। যেমন: সততা, আমানতদারি, কর্তব্য-পরায়ণতা, সাহসিকতা, অভাবীর সাহায্য, গরিবের প্রতি দয়া ও বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ইত্যাদি। সুতরাং অভিভাবক এক বা একাধিক এমন গল্প উপস্থাপন করবেন, যা তিনি শিশুকে যে আদবটির ওপর প্রতিপালন করতে চাচ্ছেন তা নিশ্চিত করবে। এর মধ্য দিয়েই তার অভীষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে।

এক্ষেত্রে জীবনীবিষয়ক গ্রন্থাবলি থেকে সাহায্য নেয়া একজন অভিভাবকের নিকট অত্যন্ত উপকারী। কারণ, এখানে শিশুর পরিচর্যায় প্রত্যশা ও প্রয়োজনের সমন্বয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ সত্য গল্পসম্ভার রয়েছে। বিশেষ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুদ্ধাভিযানসমূহ, সাহাবায়ে কেরামের (রা.) জীবনালেখ্য, তাদের বীরত্ব-গাথা ও নেতৃত্ব। আমাদের পূর্ব পুরুষগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছোট ও বড় যুদ্ধাভিযান থেকে তাদের সন্তানদের প্রতিপালনের জন্য বড় ধরনের একটা উপাদান গ্রহণ করে থাকতেন।

ইসমাঈল বিন মুহম্মদ বিন সা’দ (রহ.) বলেন, ‘আমার পিতা আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুদ্ধ সম্পর্কিত ঘটনাবলির বিবরণ শিক্ষা দিতেন। এবং গাযওয়াহ ও সারিয়াহ’র বর্ণনা দিতেন।’ এবং বলতেন- ‘হে বৎস, এ হলো তোমার বাপ-দাদার ঐতিহ্য; অতএব তোমরা এটা ভুলে যেও না।’ আলী বিন সুহাইল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছোট-বড় সকল যুদ্ধের ঘটনাবলি শিক্ষা করতাম যেভাবে আল-কোরআনের সূরাগুলো শিক্ষা করতাম।’

পক্ষান্তরে মনগড়া গল্পের মধ্যে কোনো ক্রিয়া বা প্রভাব নেই। কারণ প্রথমটা হলো সূত্রনির্ভর, বাস্তবে যার সত্যতা সুপ্রমাণিত। এটাতো শুধু কল্পনাপ্রসূত ঘটনা নয়। আল্লাহ তায়ালাও পবিত্র কোরআনে সুন্দরতম গল্পের অবতারণা করেছেন।

যেমন তিনি বলেন,

لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِأُولِي الْأَلْبَابِ مَا كَانَ حَدِيثًا يُفْتَرَى

‘তাদের কাহিনীতে রয়েছে বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষদের জন্য শিক্ষা, এটা মিথ্যা রচনা নয়।’

এ ধরনের কাহিনীতে শিক্ষামূলক অনেক বিষয় সন্নিবেশিত রয়েছে। এমনিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর প্রিয় সাহাবিদের (রা.) অসংখ্য গল্প বলেছেন। উম্মুল মুমিনীন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মিণী আয়েশা (রা.) আমাদের পূর্ববর্তী সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিদ্যমান সম্পর্ক সম্বলিত সংবাদ গল্পের আকারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতেন। যেমন একবার তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আবু যর আর উম্মে যর নামের স্বামী-স্ত্রীর প্রেমকাহিনী শোনালেন। কাহিনী শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- ‘আমি তোমার জন্য আবু যর, আর তুমি হলে আমার জন্য উম্মে যর।’

কখনও দেখা যায়, কোনো কোনো অভিভাবক এক্ষেত্রে অবাস্তব কাহিনীর আশ্রয় নেন। কিন্তু এ জাতীয় কাহিনীর ক্ষেত্রে তার বাচনিক পদ্ধতিতে আমাদের ধর্মের প্রতিটি আহ্ববান-বিশ্বাস, চরিত্র ও আচার-ব্যবহারের প্রতি পরোক্ষ উদ্দীপকের বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। তবে যে সকল গল্প অনৈসলামিক অভ্যাস ও আচরণকে উস্কে দেয় অথবা মুসলমানদের বিশ্বাসের পরিপন্থী বিশ্বাসের জন্ম দেয়, ঐ সকল কাহিনী পরিহার করা অবশ্য কর্তব্য। যদিও সেটা কোনো উৎসাহ ও উদ্দীপনার ধারক হোক না কেন। এ অবস্থায় ‘আমরা এর থেকে শুধু উপকারী অংশটুকু গ্রহণ করব, অতঃপর পরে সুযোগমতো শিশুর ভুল শুধরিয়ে দেব এমন কথা বলার অবকাশ নেই। কারণ এ বয়সে একটি শিশু যেন একটি ‘সাদা পৃষ্ঠার মতো থাকে। সেখানে অশুদ্ধ কোনো কিছু অঙ্কন করা কি শুদ্ধ হবে? যেহেতু এটা তার মেধাকে বিক্ষিপ্ত করতঃ শুদ্ধ-অশুদ্ধ সব বিষয় একাকার করে দেবে।

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –