• বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৪ ১৪৩১

  • || ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

নাইকো পুকুর চুরিঃ যারা, যেভাবে জড়িত..

নিউজ ডেস্ক

দৈনিক ঠাকুরগাঁও

প্রকাশিত: ২৫ নভেম্বর ২০১৮  

ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস তোলার অনুমতি পেতে নাইকো যে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে তার প্রমাণ পেয়েছে কানাডার রয়াল মাউন্টেড পুলিশের (আরসিএমপি) তদন্ত কর্মকর্তারা। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ‘‘নাইকো বাংলাদেশের’ দুর্নীতির বিষয়ে তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথা জানানো হয়েছিল। 

সেই সূত্রে প্রতিষ্ঠানটির কানাডার ‘করাপশন অব ফরেন পাবলিক অফিসিয়ালস অ্যাক্টের’ লঙ্ঘন করেছে কিনা, তা খুঁজে বের করতে আরসিএমপি তদন্ত শুরু করে। তদন্তকারী কর্মকর্তারা বাংলাদেশে এসে পৃথক তদন্ত করেছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই।কানাডার পুলিশ ও যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের তদন্তকারীদের যেসব প্রতিবেদন পাওয়া গেছে সেসব থেকে কারা নাইকো দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন এবং তারা একে অন্যের সঙ্গে কখন, কীভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েছেন তা জানা গেছে। এই প্রতিবেদনে প্রথমে আসে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক কাশেম শরিফের নাম। তিনি যখন ভারতে বিজে সার্ভিসেসের (ব্রাউন অ্যান্ড জ্যাকসন) জন্য কাজ করছিলেন তখন রবার্ট ওলসনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে তিনি বাংলাদেশে বিজের কান্ট্রি ডিরেক্টর হন। বাংলাদেশ হওয়ায় নাইকো বাংলাদেশের তৎপরতার জন্য ওলসন কাশেম শরিফকে বেছে নেন। কাশেম শরিফ ছিলেন তার নিজের প্রতিষ্ঠান স্ট্রাটামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। 

বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম করপোরেশনের (বাপেক্সে) সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গ্যাস অনুসন্ধানের সুযোগ পেতে নাইকো বাংলাদেশ 
তাদের প্রতিনিধি হিসেবে স্ট্রাটামকে ১৯৯৯ সালে চুক্তি করে। স্ট্রাটাম নিজের প্রতিষ্ঠান হলেও নাইকোর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রবার্ট ওলসনের ইচ্ছায় কাশেম শরিফ নাইকো বাংলাদেশে যোগ দেন। আর তার প্রতিষ্ঠানই নাইকো বাংলাদেশের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে থাকে।২৫ অক্টোবর ২০০৮ সালে নাইকো বাংলাদেশের সঙ্গে এক সময় যুক্ত থাকা শরফুদ্দিন আহমেদের সাক্ষাৎকার নেন কানাডার তদন্তকারীরা। সেখানে ফাইভ ফেদার্স নামক প্রতিষ্ঠানের শরফুদ্দিন জানান, তিনি জ্বালানি ব্যবসায় ৩০ বছর ধরে জড়িত। তার সঙ্গে কাশেম শরিফের পরিচয় সেই সময় থেকেই ছিল, যখন কাশেম শরিফ বিজে হফসের (ব্রাউন অ্যান্ড জ্যাকসন) বাংলাদেশ শাখার প্রধান ছিলেন। 

তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদনে বাংলাদেশ সরকারের সম্মতি আদায় করতে শরফুদ্দিন আহমেদকে নিয়োগ করেন কাশেম শরিফ। তার প্রত্যাশা ছিল, শরফুদ্দিন আহমেদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে ঘুষ দিয়ে কাজটি সমাধা করে ফেলতে পারবেন। নাইকো বাংলাদেশের এজেন্ট হিসেবে শরফুদ্দিন চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি ছাতক, ফেনী ও কামতা গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলনের বিষয়ে বাপেক্সের কাছে লিখিতভাবে অনুরোধও জানান। ১৯৯৯ সালে সংশ্লিষ্ট তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিষয়ে বাপেক্স ও নাইকো বাংলাদেশের মধ্যে ‘ফ্রেমওয়ার্ক অব আন্ডার্স্ট্যান্ডিং’ (এফওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত প্রত্যাশিত অগ্রগতি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় শরফুদ্দিনকে অব্যাহতি দেন কাশেম।

কাশেম শরিফের সঙ্গে গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের পরিচয় হয়েছিল তার এক বন্ধু মঞ্জুরুল ইসলামের মাধ্যমে। কানাডীয় তদন্তকারীদের কাছে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন বলেছেন, নাইকোকে সহায়তা করার বিষয়ে তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেছিলেন। মোশাররফ মামুনকে বলেছিলেন, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান গ্যাস উত্তোলনের জন্য প্রকাশ্য দরপত্র আহ্বানের পক্ষে মত দিয়েছেন। মামুনের দাবি, এটা জেনে তিনি নাইকোর প্রকল্প থেকে সরে আসেন।

জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের পুরনো পারিবারিক বন্ধু সেলিম ভূঁইয়া। গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে সেলিম ভুঁইয়ার পরিচয় করিয়েদেন মোশাররফ হোসেন। সেলিম ভূঁইয়া ২০০৫-২০০৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। ঢাকা ক্লাবের সভাপতি হিসেবে সমাজের অভিজাতদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। মামুন প্রায়ই ঢাকা ক্লাবে যেতেন। সেলিম ও মামুন একসঙ্গে গলফ খেলতেন। ২০০২ সালের কোনও একসময় কাশেম শরিফের সঙ্গে সেলিম ভূঁইয়ার পরিচয় করিয়ে দেন মামুন। সেখানে কাশেম শরিফ জানান, গ্যাস উত্তোলনের বিষয়ে বাপেক্সের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে চায় নাইকো। এ বিষয়ে গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে তার একটি সমঝোতা হয়েছে। নাইকো যদি শেষপর্যন্ত গ্যাস উত্তোলনের অনুমোদন পায়, তাহলে সেলিম ভূঁইয়াকে গ্যাসের পাইপলাইন ও গ্যাস স্টেশন বসানোর মতো কিছু কাজের সাব কন্ট্রাক্ট দেওয়া হবে। তার বদলে সেলিম ভূঁইয়াকে কয়েকটি কাজ করে দিতে হবে। সেগুলো হলো, কামতা, ছাতক ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস 
উত্তোলনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সরকারি অনুমোদন প্রাপ্তি এবং ফেনী ও ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত গ্যাস বিক্রির অনুমোদন পেতে নাইকোকে সহায়তা করা।কাশেম শরিফের সঙ্গে ওই বৈঠকের দিন সাতেক পরে মামুন ও সেলিম ভুঁইয়া তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেনের বাসায় তার সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে তিনি প্রতিমন্ত্রীকে নাইকোর বিষয়ে ‘বিস্তারিত’ জানান। ঠিক হয়, সেলিম ভূঁইয়া মন্ত্রীর সঙ্গে কাজের অগ্রগতির বিষয়ে যোগাযোগ রাখবেন এবং নাইকোর কাজ ঠিক মতো হয়ে গেলে সেলিম ভূঁইয়া যা পাবেন, তা থেকে মামুনকে ‘কিছু’ দেওয়া হবে। কেন গ্যাসক্ষেত্রের মতো প্রকল্প পেতে গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে দরকার ছিল, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কানাডীয় তদন্তকারীদের কাশেম 
শরিফ বলেছেন, মামুন অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। স্থানীয় রাজনীতিবিদরা যেন পথের বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে মামুনের মতো শক্তিশালী ব্যক্তির সহায়তার দরকার ছিল। স্থানীয় কোনও উপজেলা চেয়ারম্যান যদি কোনও রাস্তা দিয়ে ট্রাক যাওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানানোর কথা ভাবতেনও তাহলে তা তার পক্ষে বলা সম্ভব হতো না মামুন থাকার কারণে। মামুন চাইলেই প্রধানমন্ত্রীকে বলতে পারতেন কোনও প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না। তার এক ফোনকলেই সচিবের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হতো।

মোশাররফ কাশেমকে বলেছিলেন, মামুনই তার প্রধান সহায়। মোশাররফ ও তার মতো ৭/৮ জনকে মামুনই মন্ত্রী বানিয়েছিলেন যেন তারা তার বা তার দলের জন্য অর্থ জোগাড়ে সহায়তা করতে পারে। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ ১০ বারের মতো পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের কাছে নাইকোর প্রকল্পটি আটকে থাকার কারণ জানতে চেয়েছেন। কারণ পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স ছাতকের পূর্ব ব্লক নাইকোকে দিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিল।

মুখ্য সচিব সিদ্দিকীর ভূমিকা কী সে বিষয়ে কানাডীয় তদন্তকারীদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে কাশেম শরিফের বক্তব্য। আত্মপক্ষ সমর্থনকরতে গিয়ে তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়াকে দেওয়ার মতো অর্থ তাদের ছিল না। তিনি তখন একাধারে প্রধানমন্ত্রী ও জ্বালানিমন্ত্রী। তাছাড়া আমলাতন্ত্রের বিষয়টিও ছিল। সেখানে ড. কামাল সিদ্দিকী ছিলেন শীর্ষ ব্যক্তি। তিনি রাজি না হলে কোনওভাবেই অনুমতি পাওয়া যেতো না। সরকারি কোনও ব্যক্তিকে তাদের অর্থ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। অথচ ওই প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে কাশেম শরিফের আরেকটি বক্তব্য যেখানে তিনি বলেছেন, চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে একপর্যায়ে কামাল সিদ্দিকী পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে ডেকে পাঠান এবং বলেন, তাকে বিষয়টি নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান যদি মনে করেন ছাতক গ্যাসক্ষেত্র নাইকোকে দেওয়া উচিত নয়, তাহলে তাকে তার আপত্তির কারণও জানাতে হবে। এরপর কাশেম শরিফকে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ফোন করেন। তিনি বলেন, তার পক্ষে শুধু একটা কাজই করা সম্ভব আর সেটা হচ্ছে আইন মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে আইনগত বৈধতার বিষয়ে অভিমত নিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া।

কাশেম শরিফ আরেক পর্যায়ে এসে কানাডীয় তদন্তকারীদের বলেছেন, প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে পাস করাতে দরকার ছিল জ্বালানিমন্ত্রীর স্বাক্ষর। মোশাররফ হোসেন তাই নাইকোর নথি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া এতে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, প্রকল্পের অনুমোদন তিনি আগেই দিয়েছেন। এর মধ্যে সেটি বাস্তবায়ন শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। এ সংক্রান্ত নথি তাকে আবার পাঠানোর কারণ জানতে চান তিনি। নথিটি মোশাররফের কাছে ফেরত যায়। তিনি ভীত হয়ে পড়েন এবং কামাল সিদ্দিকীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। কামাল সিদ্দিকী মোশাররফকে স্পষ্টভাবেই বলেন, তাকে কাজটি করতেই হবে। এফবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন নাইকো ও বাপেক্সের মধ্যকার চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে আইন মন্ত্রণালয়ের অভিমত আনার যে দাবি করা হয়েছিল, তা পূরণে বিষয়টি যায় আইন মন্ত্রণালয়ে। সেখানে তখন মন্ত্রী মওদুদ আহমদ, যিনি আগে নাইকোর আইনজীবী ছিলেন। ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকে পূর্ব ব্লককে বাদ দেওয়া ও পরিত্যক্ত ঘোষণা না করা বেআইনি হবে বলে তিনি আইনি অভিমত দেন।

নাইকো দুর্নীতিতে কারা জড়িতঃ নাইকো দুর্নীতিতে যেসব ব্যক্তির যুক্ত থাকার কথা আরসিএমপি ও এফবিআইয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে যেমন  রয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান, তেমনি রয়েছেন নাইকো বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, জ্বালানি শিল্পে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যবসায়ী, ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও মুখ্য সচিবের  মতো ব্যক্তিও। দুর্নীতির অর্থবণ্টন করতে গিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে আরও কয়েকজনকে।

টাকা ভাগাভাগীতে যারাঃ নাইকো দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্টদের এসব ভূমিকার পাশাপাশি কানাডীয় তদন্তকারীদের তদন্তে উঠে এসেছে আরও কয়েকজনের নাম, যারা বিতরণ করা অর্থ নিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের পক্ষে। নাইকো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্ট্রাটামের সুইস ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২০০৩ সালের ২১ অক্টোবর জমা পড়ে ২৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এখান থেকে অর্থ যায় বেশ কয়েকটি অ্যাকাউন্টে, যাদের মধ্যে একটি অ্যাকাউন্ট টোকিওর ইউএনআইকিউএ করপোরেশনের। ২০০৩ সালের ২৯ নভেম্বর সেলিম ভূঁইয়ার অ্যাকাউন্টে ‘এমএস সুলতানা’ নামের একজনের অ্যাকাউন্ট 
থেকে এককোটি সাত লাখ ৫৪ হাজার ৩০০ টাকা যায়। সুলাতানার পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি তদন্ত প্রতিবেদনে।

২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর ফজলে আকবর সিদ্দিকীর অ্যাকাউন্টে যায় প্রায় ২০ হাজার ডলার। এফবিআইয়ের প্রতিবেদনে তাকে ‘কামাল সিদ্দিকীর ভাই মনে করা হয়’ উল্লেখ করা হলেও কানাডীয় তদন্তকারীদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাশেম শরিফ তাকে মামুনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ২০০৩ সালের ১১ নভেম্বর হংকংয়ের এইচএসবিসি ব্যাংকে থাকা জব্বার আব্দুল মজিদ নামের এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে যায় প্রায় ৫৭ হাজার ডলার। কিন্তু লেনদেনের তথ্য থেকে জানা যায়, তা ফেরত আসে ২০০৩ সালের ১৭ নভেম্বর। ওই দিনই ওই অর্থ ডিবিটিসিও আমেরিকাসের নিউ ইয়র্ক শাখায় থাকা একটি অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়, যার প্রাপক জামাল শামসি। তিনি ঢাকার একটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের মালিক। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, তার কাছে পাঠানো অর্থের প্রকৃত প্রাপক ছিলেন গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ভাই সংসদ সদস্য হাফিজ ইব্রাহিম। তিনি বিএনপির ওই আমলে দুটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। এফবিআইয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কাশেম শরিফের কাছ থেকে বাবুল গাজি নামের এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে অর্থ গেছে, যা আসলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে প্রভাবিত করতে মুখ্য সচিব কামাল সিদ্দিকীর জন্য পাঠানো হয়েছিল। কাশেম শরিফ এ তথ্যের সত্যতা অস্বীকার করেছেন।

মামুন ও সেলিম নাইকোর চুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি জানতে নিয়মিত মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। ২০০৩ সালের শেষ দিকে বাপেক্স-নাইকো জেভিএ স্বাক্ষরিত হয়। জেভিএ সফলভাবে স্বাক্ষরিত হওয়ায় সুইজারল্যান্ডে কাশেম শরিফের নিয়ন্ত্রণাধীন অ্যাকাউন্টে জমা হয় ২৯ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। পরে সেখান থেকে কাসিম ৫ লাখ ডলার (প্রায় তিন কোটি টাকা) বাংলাদেশে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে সেলিমের অ্যাকাউন্টে দেন।জবানবন্দিতে সেলিম জানান, এই টাকা থেকে মামুনকে একটি পে অর্ডারের মাধ্যমে দিয়েছেন ১ কোটি ৮ লাখ টাকা এবং বাকি টাকা নগদ ও চেকের মাধ্যমে। তিনি মনে করেন, মামুনকে দেওয়া এই টাকা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে ভাগাভাগি করা হয়েছে। সেলিম আরও জানান, মোশাররফ হোসেনকে একই অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া হয় ৬০ লাখ টাকা এবং নিজের লবিং ফি হিসেবে বাকি ৬০ লাখ টাকা রাখেন।
ডেবরা গ্রিফিত তার দেওয়া সাক্ষ্যে আরও বলেছেন, বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণে দেখা যায়, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান এবং অন্যদের ঘুষ দেওয়ার জন্য কাশেম শরিফ নিয়োগ দিয়েছিলেন সেলিম ভুঁইয়াকে। আমার তদন্তে উঠে এসেছে, কাশেম শরিফ নিয়ন্ত্রিত অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা গিয়েছে সেলিম ভুঁইয়া, বাবুল গাজী ও জামাল শামসির কছে। প্রমাণ রয়েছে এসব অর্থ ছিল ঘুষের অর্থ। যা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ অন্যদের দেওয়ার জন্য মধ্যস্থতাকারীদের হাতে দেওয়া হয়েছে।এফবিআই কর্মকর্তা আরও বলেছেন, তদন্তে উঠে এসেছে যে, ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন নাইকো ও বাপেক্সের মধ্যকার জেভিএ স্বাক্ষরের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলাটি দায়ের করে দুদক। ২০০৮ সালের ৫ মে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেয় দুদক। মামলায় অভিযোগে বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর হাতে ‘তুলে দেওয়ার’ মাধ্যমে আসামিরা রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করেছেন।মামলার অন্য আসামিরা হলেন—সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব সি এম ইউছুফ হোসাইন, বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, বাপেক্সের সাবেক সচিব শফিউর রহমান, ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, বাগেরহাটের সাবেক এমপি এম এ এইচ সেলিম এবং নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরিফ।

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –