• রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

  • || ০৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শুদ্ধাচার পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা ও মাপকাঠি

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৯ জুলাই ২০২৪  

বেশ কয়েকটি গুণাবলিকে মানদণ্ড ধরে সরকারি চাকরিজীবীদের দেওয়া হয় শুদ্ধাচার পুরস্কার। তবে শুদ্ধাচার পুরস্কার পাওয়া সরকারের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। সম্প্রতি গণমাধ্যমে তাদের নিয়ে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সরকার নড়েচড়ে বসেছে। এরই মধ্যে নিয়েছে আইনগত ব্যবস্থাও।

এদের মধ্যে ২০২২ সালে জাতীয় পর্যায়ে শুদ্ধাচার পুরস্কার পান তৎকালীন আইজিপি বেনজীর আহমেদ। তার এই পুরস্কার কতটা যৌক্তিক ছিল, সে প্রশ্নই ইদানীং জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে। এরই মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগে বেনজীর আহমেদের সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে। সপরিবারে তিনি বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন। তথ্যসূত্র- বিবিসি বাংলা
এক সময়ে জামালপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ছিলেন আহমেদ কবীর। তিনিও বিভাগীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার পান। এর দু-এক মাস পরই নিজ কার্যালয়ে এক নারীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটানোর ভিডিও ভাইরাল হয়। এর জেরে দায়িত্ব থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

সরকারের শীর্ষ এই দুই কর্মকর্তার দুর্নীতি ও অসামাজিক কার্যকালাপের পর ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। কোন মাপকাঠিতে তাদের দেওয়া হয় এই পুরস্কার? এই প্রশ্ন এখন অনেকের। এছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এই পুরস্কার কতটুকু ভূমিকা রাখছে, এসব নিয়েও অনেকে কথা বলছেন।

শুদ্ধাচার পুরস্কার হিসেবে একটি সার্টিফিকেট এবং এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই পুরস্কারে অর্থের চেয়ে স্বীকৃতিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

শুদ্ধাচার কী ও কেন?

সরকারের নানা প্রতিষ্ঠানের অনেক আগে থেকেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশকে প্রথম অন্তর্ভুক্ত করা হয় ২০০১ সালে।

প্রথমবারেই দেশটির অবস্থান হয় তালিকার শীর্ষে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জরিপেও বাংলাদেশ দশম স্থানে অবস্থান করছে।

এই প্রেক্ষাপটে ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠার’ লক্ষ্য নিয়ে ২০১২ সালে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়ন করা হয়। সেখানে শুদ্ধাচার-এর একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে।

শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ বোঝায়। এর দ্বারা একটি সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্যও বোঝানো হয়। ব্যক্তিপর্যায়ে এর অর্থ হলো কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা তথা চরিত্রনিষ্ঠা।’

এতে আরো বলা হয়, প্রাতিষ্ঠানিক শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তি পর্যায়ে শুদ্ধাচার অনুশীলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, কৌশল প্রণয়ন করা হলেও এটি বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এটি কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট লোকদের বেশিরভাগ হয়তো এটা খুলেই দেখেননি।

বাংলাদেশের সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, শুদ্ধাচার কৌশলের ‘উদ্দেশ্য মহৎ থাকলেও পরে দেখা গেল এটা তেমনভাবে কার্যকর নয়’। শুদ্ধাচার কৌশলের ধারাবাহিকতায় প্রবর্তন করা হয় ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’।

শুদ্ধাচার পুরস্কার পেতে যা যা গুণ লাগবে?

শুদ্ধাচার পুরস্কারটি ২০১৭ সালে চালু করা হয়। পুরস্কারের আওতায় আসেন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব পদমর্যাদা থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ১৫টি ধাপে মনোনয়নের ব্যবস্থা রাখা হয়।

এই পুরস্কার পেতে যে ১৮টি গুণাবলিকে মানদণ্ড হিসেবে ধরা হচ্ছে সেখানে পেশাদারিত্বের পাশাপাশি আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির মতো বিষয় স্থান পেয়েছে।

পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা, সততার নিদর্শন, নির্ভরযোগ্যতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ, সহকর্মী ও সেবাগ্রহীতার সঙ্গে আচরণসহ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের পারদর্শিতা এমনকি ছুটিগ্রহণের প্রবণতাকেও রাখা হয়েছে তালিকায়।

প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের জন্য পাঁচ নম্বর করে ধরা হয়েছে। এতে মোট নব্বই নম্বর। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ধার্য করা অন্যান্য কার্যক্রম পালনের ওপর রাখা হয়েছে ১০ নম্বর। সব মিলিয়ে একশ। এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই এ পুরস্কার প্রদানের জন্য কর্মচারী নির্বাচন করা হয়ে থাকে।

তবে এই পুরস্কারের জন্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে এই মাপকাঠি আদৌ মানা হয় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান।

তিনি বলেন, সিলেকশন প্রসেস ত্রুটিপূর্ণ ছিল বলেই এখন মনে হয়। কারণ, যাদের শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তাদের অনেকেই অশুদ্ধ কাজে জড়িয়ে পড়েছেন।

আর টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ঢালাওভাবে এর অপব্যবহার করা হয়েছে। শুদ্ধাচার পুরস্কারের সিদ্ধান্তটা নেয়ার ক্ষেত্রে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। যা সুবিধা অর্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রাপ্তির যোগ্যতা—

শুদ্ধাচার পুরস্কারের নীতিমালায় প্রার্থীর যোগ্যতা হিসেবে ছয়টি বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো-

১. বিবেচ্য কর্মচারীকে সংশ্লিষ্ট অর্থবছরে ন্যূনতম ছয় মাস সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে হবে।

২. কোনো কর্মচারীর গুণাবলির সূচকের বিপরীতে প্রাপ্ত সর্বমোট নম্বরের ভিত্তিতে সেরা কর্মচারী হিসাবে মূল্যায়ন করা হবে।

৩. কোনো কর্মচারীর মোট প্রাপ্ত নম্বর ন্যূনতম ৮০ না হলে তিনি শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন না।

৪. সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্ত কর্মচারী শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন।

৫. মূল্যায়নের পর একাধিক কর্মচারী একই নম্বর পেলে লটারির ভিত্তিতে সেরা কর্মচারী নির্বাচন করতে হবে।

৬. কোনো কর্মচারী যে কোনো অর্থবছরে একবার শুদ্ধাচার পুরস্কার পেলে তিনি পরবর্তী তিন অর্থবছরের মধ্যে পুনরায় পুরস্কার পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন না।

ড. ইফতেখারুজ্জামানের মতে, মাপকাঠি ঠিক করা হলেও বাছাই করার ক্ষেত্রে যোগ্যদের সাথে বৈষম্য করা হয়েছে। যারা সত্যিকার অর্থে শুদ্ধাচার চর্চা করেন তাদের সাথে বৈষম্য করা হয়েছে। এতে এমন বার্তা গেছে, যে শুদ্ধাচার চর্চা না করেও পুরস্কার পাওয়া যায়, কাজেই আর শুদ্ধাচার চর্চার প্রয়োজন নেই। এ কারণেই ইতিবাচক ফল মেলেনি।

এদিকে শুদ্ধাচার পুরস্কার নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, শুদ্ধাচার কৌশল ও শুদ্ধাচার পুরস্কার নিয়ে সরকারের নতুন করে ভাবা উচিত।

– দৈনিক ঠাকুরগাঁও নিউজ ডেস্ক –